ইফতারের সময়ে সূর্যাস্তের সাথে সতর্কতামূলক সময় যোগ করা প্রয়োজন আছে কিনা?

 
সকলেই বিষয়ে একমত যে ইফতার করতে হবে সূর্যাস্ত নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে এটা নিশ্চিত হবার পর ইফতার করার জন্য আজান শোনা বা আরো বিলম্ব করার সুযোগ নাই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সূর্যাস্ত নিশ্চিত হই কিভাবে?

বর্তমান সময়ে আমরা কেউ আর সূর্যাস্ত অবলোকন করে ইফতার করি না। সকলেই আবহাওয়া অফিস থেকে প্রাপ্ত সূর্যাস্তের সময় কিংবা গুগল বা অ্যাপের সাহায্যে সূর্যাস্তের সময় জানতে পারি

বাস্তবতা হচ্ছে: আবহাওয়া অফিস বা গুগল থেকে আপনি সূর্যাস্তের যে সময়টা জানতে পারেন সেটি শতভাগ বিশুদ্ধ নয়। সময়গুলো approximate rounded ফরমেটে পাওয়া যায়। ক্যালেন্ডারে সূর্যাস্ত দেখাবে :৫০, যদিও সত্যিকার সূর্যাস্ত হলো :৫০ বেজে ৩০ সেকেন্ডে। এটাকেই রাউন্ড ফিগার করে :৫০ দেখায়। আবহাওয়া অফিস পুরো জেলার জন্য একটি সূর্যাস্তের সময় প্রকাশ করে। কিন্তু জেলার কেন্দ্র থেকে যত দূরত্বে যাওয়৷ হবে সূর্যাস্তের সময়ে কম-বেশি হবে। এখানেই আসে আবহাওয়া অফিসের সময়ের সাথে সতর্কতামূলক সময় যোগ করার প্রশ্ন।

তবে সতর্কতামূলক সময় যোগ করাই আমাদের হিসেবে উত্তম নিরাপদ।

কারণ:  প্রথমত সূর্যাস্তের "approximate” (আনুমানিক) সময়ের সাথে মিনিট সতর্কতামূলক সময় যোগ করার ব্যাপারে দেশের আলেমদের মত রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ক্যালেন্ডারেও সতর্কতামূলক তিন মিনিট সময় যোগ করা হয়। 

দ্বিতীয়ত আবহাওয়া অফিস, গুগল বা কোনো অ্যাপ সূর্যাস্তের সময় হিসাবে যে সময় দেখায় তা সত্যিকার অর্থেই এক্সাক্ট সময় নয়। এজন্য আমরা সূর্যাস্তের সময়কে approximate বা আনুমানিক বলেছি। এখানে কিছু সেকেন্ডের বা মিনিটের হেরফের থাকতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। মানিকগঞ্জ জেলার সূর্যাস্তের সময় জানতে সার্চ দিলাম। কোনো একটি ওয়েবসাইট থেকে ক্রল করে গুগল দেখালো মানিকগঞ্জ জেলায় আজকের সূর্যাস্তের সময় :১২। এর মানে কি সূর্য ৬টা বেজে ১২ মিনিটে টুপ করে ডুবে যাবে? অথবা একদম মিনিট ধরে টা ১২ মিনিটেই সূর্য পূর্ণ ভাবে অস্তমিত হবে? সারা মাসে একদিনও মিনিটের রাউন্ডেড ফিগারে এলোমেলো হবে না? তা নয়! MapLogs.Com ওয়েবসাইট থেকে জানলাম প্রকৃত সূর্যাস্তের সময় ৬টা বেজে ১২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড। এখানেও মিলিসেকেন্ডের হিসাব বাদ দেয়া হয়েছে। সূর্যাস্ত আরো আগে থেকে শুরু হয়ে ৬টা ১২ মিনিট ৫৩তম সেকেন্ড

পূর্ণরূপে অস্তমিত হয়। গুগল বা অন্যান্য অ্যাপ এই সময়টিকেই ৫৩ সেকেন্ড বাদ দিয়ে রাউন্ড ফিগার করে ৬টা ১২ মিনিট দেখায়। গুগলের জন্য বা অন্য ধর্মের মানুষদের জন্য এই ৫৩ সেকেন্ড হয়ত ধর্তব্য নয়। কিন্তু একজন রোজাদার কি জেনে শুনে সূর্যাস্তের ৫৩ সেকেন্ড আগে ইফতার করতে পারেন?

অবশ্যই নয়! সূর্য পূর্ণ ভাবে অস্তমিত হওয়ার ৫৩ সেকেন্ড আগে ইফতার করলে আপনার রোজাটি নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি একটু চোখটা বন্ধ করে চিন্তা করুন। যদি কেউ আপনাকে আবহাওয়া অফিস কিংবা গুগলের রাউন্ডেড ফিগার সূর্যাস্তের সময় দেখে ইফতার করতে বলে, তাদের কারণে আপনার রোযা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো? আসলেই কি তারা আপনার শুভাকাঙ্খী? হাদীসের উদ্দেশ্য কি গুগল বা আবহাওয়া অফিসের রাউন্ডেড ভ্যালুতে ইফতার করা? হাদীসে কি আছে নিশ্চিত ঝুঁকির কথা জেনেও আবহাওয়া অফিসের সময় দেখে ইফতার করতে?

তৃতীয়ত

আবহাওয়া অফিস থেকে জেলাভিত্তিক সূর্যাস্তের সময় জানা যায়। সে সময়টা জেলার কেন্দ্র বিন্দু থেকে সূর্যাস্তের সময়, অথবা হতে পারে সমগ্র জেলার সূর্যাস্তের সময়ের একটা গড় মান। কোনো একটা স্থান থেকে প্রতি কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করার সাথে সাথে সূর্যাস্তের সময়ের পার্থক্য হতে পারে আড়াই সেকেন্ড। এভাবে আপনার বাড়ি, জেলা শহর থেকে অনেক দূরে হলে, জেলার সূর্যাস্তের সময়ের সাথে আপনার বাড়ির সূর্যাস্তের সময়ে পার্থক্য হতে পারে।

ধরুন একজনের বাড়ি জেলা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে। তার জন্য আপনার সমাধান কী হবে? তিনি কি জেলার কেন্দ্রের সূর্যাস্তের সময়ে ইফতার করবেন? প্রতি কিলোমিটার দূরত্বের জন্য সূর্যাস্তের সময় সেকেন্ড পরিবর্তন ধরে হিসাব করলে সময়টা আসবে 90*2=180 সেকেন্ড বা মিনিট। এই ব্যক্তি যদি তার জেলা শহরের সূর্যাস্তের সময়ের সাথে মিনিট যোগ/বিয়োগ করে ইফতার করেন তাহলে এটাকে কি হাদীস বিরোধী বলব?

চতুর্থত

সূর্যাস্ত হিসাব করা হয় সমতলের সাপেক্ষে। অর্থাৎ সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত হওয়ার সময় হিসাব করা হয়। এখন আপনি যদি ২০ তলা বিল্ডিংয়ের উপরে বসে ইফতার করেন তাহলে কি একই সময়ে ইফতার করবেন? অথবা কয়েক তলা মাটির নিচের আন্ডার গ্রাউন্ডে বসে ইফতার করার সময়ও কি একই সময়ে ইফতার করবেন? সমতল থেকে যখন দেখা যাবে সূর্য অস্ত গিয়েছে, বিল্ডিংয়ের উপর থেকে তখনও সূর্য দেখা যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডের হিসাব ওঅন্যরকম হতে পারে!

তাহলে আপনি সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতারের বিষয়টা কিভাবে নিশ্চিত করবেন?

একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফার নিচতলা এবং টপ ফ্লোরের ইফতারের সময়ের মাঝে মিনিটের পার্থক্য হয়ে থাকে। সেখানকার জন্য ফতোয়া হচ্ছে যারা সমতল থেকে ৮০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় থাকবেন তারা মিনিট পর ইফতার করবেন। অন্যথায় রোজা শুদ্ধ হবে না। কারণ নিচতলার ব্যক্তির জন্য সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও, টপ ফ্লোরে যিনি আছেন তিনি তখনও সূর্য দেখতে পাচ্ছেন। যদিও এই কারণটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। তবুও তথ্যটা শেয়ার করা রাখা হলো।

পঞ্চমত

মোবাইল ফোনের GPS ব্যবহার করে যেই সূর্যাস্তের সময় পাওয়া যায় সেটিও শতভাগ সঠিক আউটপুট দিতে পারে না। এটা সব সময় গ্যারান্টেড নয় যে, আপনার ফোনের জিপিএস সব সময় আপনাকে শতভাগ নিশ্চিত আউটপুট দিবে। অ্যাপ থেকে ডিভাইসের কাছে জিপিএস লোকেশন জানতে চাওয়া হয়। আপনার ফোনের অপারেটিং সিস্টেম লোকেশনটা অ্যাপকে প্রোভাইড করে। এসময় last known location রিটার্ন করতে পারে।

ধরুন আপনি কোথাও ট্রাভেল করছেন। আপনার বাড়ি থেকে বহু দূর চলে এসেছেন। চট করে ফোনটা বের করে সময় দেখলেন। হতে পারে আপনার ফোন আপনার বাড়ির লোকেশনই রিটার্ন করবে। যদিও আপনি অনেক দূর চলে এসেছেন। এসব কারণে রোজার মত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আমলের ক্ষেত্রে আমরা জিপিএসের উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারি না। দুটি ফোন পাশাপাশি রাখলেও এদের জিপিএস লোকেশনের latitude longitude এর মান ভিন্ন হতে পারে। এই ভিন্নতার ফলে সময়ের হিসাবে সূক্ষ্ম পার্থক্য চলে আসতে পারে।

উপসংহার

এসকল বাস্তবিক এবং বৈজ্ঞানিক কারণেই আলেমগণ সূর্যাস্তের যে সময় আবহাওয়া অফিস থেকে পাওয়া যায় তার সাথে সতর্কতার জন্য মিনিট সময় যোগ করার পরামর্শ দেন। যেন আপনি জেলা শহর থেকে অনেক দূরে থাকলে, কিংবা অনেক উচু বিল্ডিংয়ে অবস্থান করলেও সকল ক্ষেত্রেই ইফতারটা সূর্যাস্তের পরেই হয়।

এসকল বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা ছাড়াই যারা বলেন, সতর্কতার জন্য সূর্যাস্তের সময়ের - মিনিট পর ইফতার করলে সেটা ইহুদি খৃষ্টানদের অনুসরন করা হবে, তাদের এই কথাকে আমরা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করছি।

হাদীসে সূর্যাস্ত নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। গুগল দেখে বা আবহাওয়া অফিস থেকে প্রাপ্ত আনুমানিক সময়ে ইফতার করতে বলা হয় নি। হাদীসে এটাও বলা হয় নি যে নিশ্চিত ভুল জানার পরেও সেই ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। আশা করি আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, কী কারণে আবহাওয়া অফিস বা গুগল থেকে প্রাপ্ত সম্ভাব্য সূর্যাস্তের সময়ের সাথে সতর্কতামূলক সময় যোগ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.